আন্তর্জাতিক ক্রাইম নিউজ চট্টগ্রাম দেশের খবর পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রেকিং নিউজ

খাগড়াছড়িতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা-বাঙ্গালিদের রেকর্ডীয় ভূমি দখলের চেষ্টা

নুরুল আলম/আবুল হোসেন রিপন: জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্কুল ও ধর্মীয় উপাসনালয় প্রতিষ্ঠাসহ নানা কৌশলে বাঙ্গালিদের রেকর্ডীয় জায়গা, নিরাপত্তাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্প ও সরকারি খাস খতিয়ানের ভূমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এসব ভূমি দখল প্রক্রিয়ার নেপথ্যে থাকার অভিযোগ উঠেছে। দখল করা জায়গায় অন্যত্র থেকে উপজাতীয় পরিবারদের এনে পুর্নবাসন এবং বৌদ্ধ বিহার, কিয়াং ইত্যাদি ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করা হচ্ছে।
আশির দশকে তৎকালীন শান্তিবাহিনীর জ্বালাও পোড়াও এবং হত্যাযজ্ঞের মুখে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বসতবাগিচা ফেলে আসা বাঙ্গালি পরিবারদের ঐসব জায়গাগুলোর অধিকাংশই ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ, সন্ত্রাসীদের হাতে দখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে প্রশাসনের কোন সহানুভূতি- সহযোগিতাও তারা পাচ্ছেন না তারা। ফলে অনেক পরিবার ইতোমধ্যে পার্বত্য এলাকা ছেড়ে সমতল জেলায় চলে গেছেন।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রামগড়ের দুর্গম এলাকা ছোট বেলছড়ি, গরু কাটা, লালছড়ি, সাতক্ষীরা পাড়া, তৈছাগাড়া, থানাচন্দ্র পাড়া, গৈয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকায় বাঙ্গালীদের প্রায় দেড়শ একর রেকর্ডীয় জায়গা জোর করে দখল করে নেওয়া হয়েছে।
ইউপিডিএফের প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালিদের এসব ভূমি দখলে প্রত্যক্ষভাবে মদদ ও সহযোগিতা দিচ্ছে। দখল করা এসব জায়গার মধ্যে দক্ষিণ লালছড়িতে জগদীশ চন্দ্র নাথ নামে এক ব্যক্তির রেকর্ডীয় তিন একর ভূমি কথিত স্কুল প্রতিষ্ঠার নামে জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে।
জগদীশ জানান, ২০০৮ সালে ইলিয়াছ মিয়া নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে রামগড় মৌজার ১০২ নং হোল্ডিংয়ের তিন একর টিলা ভূমি কিনে নিজ নামে রেজিষ্ট্রি করার পর সেখানে বনজ গাছের বাগান সৃজন করেন। সম্প্রতি একটি উপজাতি সন্ত্রাসী গ্রুপের লোকজন বাগানের সমস্ত গাছগাছালি কেটে জায়গাটি জোরপূর্বক দখল করে। তারা স্কুল প্রতিষ্ঠার নামে ঐ জায়গার উপর একটি ঘরও নির্মাণ করেছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানালে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তারা জগদীশেকে প্রাণ নাশের হুমকীও দিয়েছে’ বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হতে দুর্গম লালছড়ি এলাকায় সরেজমিন পরির্দশন করে দেখা যায়, জনবসতিহীন গভীর বনের মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় টিনের ছাউনীর একটি লম্বা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী এলাকার জনৈক ব্যক্তি জানায়, ‘ভিতরের পার্টি’র লোকেরা (পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপকে স্থানীয়রা ভিতরের পার্টি নামে আখ্যায়িত করে) রাতের আধাঁরে ঘরটি নির্মাণ করেছে।
তিনি আরও জানান, জায়গাটি দখল করার জন্যই স্কুল প্রতিষ্ঠার নামে ঘরটি তৈরী করা হয়।
জানা যায়, লালছড়ি এলাকার পার্শ্ববর্তী সাতক্ষীরা পাড়া ও ছোট বেলছড়ি পাড়ার প্রায় ৩০টি বাঙ্গালী পরিবার সন্ত্রাসী গ্রুপের নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়ে ঘরবাড়ি, বাগানবাগিচা ফেলে অন্যত্র চলে গেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রামগড় উপজেলার পাতাছড়া ইউনিয়নের দুর্গম ছোট বেলছড়িতে ২০-২৫টি বাঙ্গালি পরিবার ছিল। ২০১৫’র মে মাসে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা দুটি বাঙ্গালি পরিবারের ওপর প্রথম হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা ঐদিন পরিবার দুটির তিনজন নারীকে গণধর্ষণসহ বেদম মারপিট করে ১০-১২জনকে আহত করে। তারা ঘরবাড়ি ভাংচুর ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় রামগড় থানায় মামলা করার কারণে সন্ত্রাসীরা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। পরবর্তীতে বাঙ্গালী পরিবারগুলোর বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, হামলাসহ লাগাতার নির্যাতন নিপীড়নের কারণে সবাই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। একই কায়দায় সাতক্ষীরা পাড়ার ৭টি পরিবারের ওপর নানা নির্যাতন চালিয়ে তাদের মধ্যে ছয়টি পরিবারকে এলাকা ছাড়া করা হয়।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে সাতক্ষীরা পাড়ার ইমান আলীর ফেলে যাওয়া মাটির তৈরী দুটি বসতঘর পরিত্যক্ত পড়ে থাকতে দেখা যায়। জানা যায়, বাঙ্গালী পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে তাদের ফেলে যাওয়া জায়গাতে উপজাতীয় পরিবারদের এনে বসতি গড়ে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, রামগড় ইউনিয়নের ২২৯ নম্বর রামগড় মৌজার তৈচাগাড়া, থানা চন্দ্র পাড়া ও গৈয়াপাড়া এলাকায় ১৪টি বাঙ্গালী পরিবারের প্রায় ৭০ একর রেকডীয় টিলা ভূমির গাছপালা কেটে কাঁচাঘর নির্মাণ করে কতিপয় উপজাতি বসতি গড়ে তুলছে। ইতিমধ্যে ৫০-৬০টি উপজাতীয় পরিবার ঘর তৈরী করে সেখানে বসবাস শুরু করেছে।
ইউপিডিএফের প্রসীত গ্রুপের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে এসব উপজাতীয় পরিবারগুলোকে এনে বাঙ্গালীদের জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছে।
উত্তর লামকু পাড়ার বাসিন্দা সৈয়দের রহমান তৈচাগাড়া পাড়ায় তার নামে রেকর্ডীয় ৮৭৮ নম্বর হোল্ডিংয়ে সাড়ে ৩ একর এবং ২২৮ খতিয়ানে দুই একর জায়গা রয়েছে। সম্প্রতি কতিপয় উপজাতি জায়গার গাছপালা কেটে ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করে। বাধা দিলে ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা তাকে হুমকী দেয়।
তিনি বলেন, তৈচাগাড়া এলাকায় একইভাবে নজিরটিলার ফরিদ মিয়ার ২৩৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ একর, সোনাইআগা গ্রামের নুরুল হকের ৭৪৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ একর, আবু সায়েদের ৫ একর, হানিফ মজুমদারের ৯২৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ একর, আবুল হোসেনের থানা চন্দ্র পাড়া এলাকায় ২০৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ একর, আব্দুল মালেকের ৫ একর, কালাডেবার নুরুল ইসলামের ৫ একর, বলিপাড়ার আবু আহম্মদের ৯৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ একর, আহম্মদ উল্লাহর ৭৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ একর, হেদায়েত হোসেনের ৮৬১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ একর, সোনাইপুলের মো: শাহ আলমের ৫ একর ও দক্ষিণ বালুখালীর সুলতান আহমেদের গৈয়াপাড়ার ১০ একর টিলা ভূমি উপজাতীয়রা দখল করে নিয়েছে।
সোনাই আগার আব্দুল মান্নান বলেন, ৫০-৬০টি উপজাতীয় পরিবার তাদের এ রেকর্ডীয় জায়গার উপর বসতি স্থাপন করে দখল করে নিয়েছে। ইউপিডিএফের সদস্যরা লক্ষ্মীছড়ি ও মানিকছড়ির বিভিন্ন স্থান থেকে এসব উপজাতি পরিবারগুলোকে এনে ঘর বানিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। জায়গা উদ্ধারের জন্য তারা জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে আবেদন অভিযোগ করেও কোন ফল পাননি।

রামগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলগের আহবায়ক শাহ আলম মজুমদার বলেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালিদের উচ্ছেদ করে তাদের বসতবাগিচা দখল করে নিচ্ছে। তার ইউনিয়নের বহু বাঙ্গালি পরিবারবাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
বাঙ্গালিদের রেকর্ডীয় জমি দখলের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে রামগড় উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) জানান, অভিযোগকারীদের জায়গার বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছ্বদের জন্য তাদেরকে আদালতে মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এদিকে, ধর্মীয় উপাসনালয় প্রতিষ্ঠার নামেও বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন, নিরাপত্তাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্পসহ সরকারি খাস ভূমি কৌশলে দখল করার তথ্য পাওয়া গেছে।
নানা কৌশলে বাঙ্গালিদের রেকর্ডীয় ভূমি দখলের ব্যাপারে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক বলেন, তিনি এ জেলায় সদ্য যোগদান করেছেন। বিষয়টি এখনও পর্যন্ত কেউ তাকে জানায়নি। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *